Archive for the ‘সংস্কার’ Tag

নিয়মতন্ত্রে বিশ্বাস-অবিশ্বাস

সমাজ কথাটা জড় বস্তুর মত শোনালেও, মানুষই এর ধারক এবং বাহক আর সেই কারনেই হয়তো এই ব্যবস্থার নিয়ম কানুনগুলো ছায়ার মত সবসময় আমাদের পেছনে পেছনে থাকে। একটু বেচাল হয়েছো কি তোমার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে।আমাদের এই সমাজব্যবস্থা খুব সুন্দর, ভালো তা তো বলা যায় না।

এমন অনেকে আছেন যারা বাইরে প্রগতিশীলতার কথা বললেও ভেতরে ভেতরে ভীষণভাবে অন্ধ, যাকে বলা যায় নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারে বিশ্বাসী। নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারপন্থী বলে আমি তাদের বলছি যারা তার নিজের ধর্ম সম্মন্ধে যে সামান্য জ্ঞানটুকু রাখা প্রয়োজন তার কিছুই জানেন না, শুধু মাত্র কিছু অযৌক্তিক নিয়ম-সংস্কার মেনে চলেন আর অপরকেও সেগুলো মানতে বাধ্য করেন।

এদের মধ্যে ধার্মিক, অধার্মিক, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, কমিউনিস্ট সকলেই আছেন। এরা নিজেদের ধর্ম বা বিশ্বাসে ঠিকমত বিশ্বাসও করেন না— কারণ তারা ঐশ্বরিক চিন্তা থেকে দূরে থাকেন, বেদ-কোরাণ-ক্যাপিটাল অথবা কোনও ধর্মগ্রন্থের চিন্তাকে ভাবার চেষ্টা করে দেখেননি, উৎসবে অথবা মিলাদের সময়ে পুরুত-মোল্লা-বড় কমরেডের নিয়ম ব্যাখ্যাতেই তারা সন্তুষ্ট। বই পড়েন না, পড়ার ইচ্ছে নেই। ইতিহাস জানেন না, জানার ইচ্ছে নেই। যদিও নিজকল্পিত ‘ধর্ম’ নিয়ে হুজুগে এরাই মাতেন সবচেয়ে বেশি। ইচ্ছে না হলেও যাবতীয় নিয়ম তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন, হিংস্র হয়ে উঠবেন— এমনই এই নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারে বিশ্বাসীরা। এরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক—কারণ এরা কোন যুক্তি মানেন না। এরাই সংখ্যাগুরু।

আমার দেখা একটি ঘটনার কথা বলি।

একদিন একটি ছেলের মা মারা যায়। ছেলেটি একটি এনজিও’তে কাজ করে, গ্রামে-গঞ্জে পড়ে থাকে, কিছু অর্থে যুক্তিবাদি, খানিকটা সংস্কারমুক্ত। তা মা মারা যাওয়ার পড়ে ওর বাড়ীতে হুলুস্থুলু পড়ে গিয়েছিল; কারণ তার প্রতিবাদী সত্তা বলে উঠেছিল যে সে কোনওরকম হিঁদু নিয়ম কানুন পালন করবে না। সেই সময় তার আত্মীয়স্বজন, আর বিশেষ করে তার বোন বেশ হিংস্র হয়ে উঠেছিল। বলেছিল সে হিন্দু সংস্কারে বিশ্বাসী নাই হতে পারে কিন্তু তার মা তো বিশ্বাসী ছিলেন, অতএব তাকে নিয়ম পালন করতেই হবে। না হলে তার মায়ের আত্মার শান্তি হবে না। সেই ছেলেটি প্রতিবাদ করতে পারেনি কারণ সে এতটাই শোকাহত ছিল। তার মনে হয়েছিল এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে যে পরিমান এফোর্ট দিতে হবে সেই মুহূর্তে তার পক্ষে তা সম্ভব নয়। নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারবোধ যুক্তির পরোয়া করেনি— মৃত ব্যক্তির শরীর ভস্মীভূত হয়ে গেছে; যে বেঁচে আছে তার মূল্যবোধকে অন্ততপক্ষে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

আর একজনের জীবনে ঘটনাটি একটু অন্য। সে তার মায়ের মৃত্যুর পর কোন রকম নিয়ম কানুন পালন করেনি। কিন্তু তার মা মৃত্যুর আগে পাড়া-প্রতিবেশিদের বলে গেছিলেন যে তার ছেলে কোন রকম নিয়ম পালন করবেন না তিনি জানেন; কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশী যেন তাঁর মৃত্যুর পর হিঁদু নিয়ম যেন পালন করে ইত্যাদি। অন্য কোন আসুবিধায় সাহায্য না করলেও, সেই পাড়া-প্রতিবেশি সেদিন চাঁদা তুলে হিঁদুয়ানির সংস্কার পালন (পড়ুন, মৃত্যুকে উপলক্ষ্য করে কুৎসিত ভোজ) করতে এগিয়ে এসেছিলো ।

তবুও কিছু পুরুষরা এই সব নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পেরেছেন। কিন্তু যে মেয়েরা চেষ্টা করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ঘটনা যে আরো করুণ পরিণতির দিকে গিয়েছে, সেটা খুব কষ্ট করে কল্পনা করতে লাগে না।

একটি মেয়ে সে যদি কোন হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ের পর সিঁদুর বা শাখা-পলা কিছু না পরে তাহলে তাকে যে তার শ্বশুরবাড়ি, রাস্তাঘাট, কাজের ক্ষেত্রে কত বার যে কিছু অর্থহীন প্রশ্নের বা মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হয়— সে সিঁদুর কেন পরে না? তাকে তো দেখে বোঝাই যায় না যে সে বিবাহিত, ইত্যাদি। তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব জনে জনে বলে বেড়ানো সম্ভব, নাকি নিজের গায়ে একটা পোস্টার এঁটে ঘুরে বেড়িয়ে জানানো— ওরে, সিঁদুর কনসেপ্টটা এসেছে সম্পত্তির ভাবনা থেকে! প্রাগৈতিহাসিক গোষ্টিসমাজের নিয়ম থেকে এটা এসেছে রে, যেখানে বল্লম দিয়ে কপাল চিরে পুরুষ তার সোনা-দানা, জমি-বাড়ীর, গরু বাছুরের মত নিজের ‘স্ত্রীধন’কেও চিহ্নিত করতো।

এই অশিক্ষা আর নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারের অন্ধকারের মাঝখানেই আমরা বাস করি। নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষের মানুষজনকে ‘শিক্ষিত’ বলতে আমার আপত্তি আছে- এরা অক্ষর চিনতে সক্ষম হলেও অক্ষরের ভেতরের মর্মার্থকে আজও বুঝতে শেখেনি, অক্ষর ও মানুষের মনের স্বাধীন ইচ্ছে আর কল্পনা নিয়ে এরা ভাবিত নয়। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কাঠমোল্লাদের থেকেও গোঁড়া এই অশিক্ষিত, ক্ষতিকারকভাবে রক্ষণশীল, আর নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারপন্থী শ্রেণিকে বোঝানোর মত খুব দুঃসাধ্য কাজ আর কি থাকতে পারে! তবু মন স্বাধীন, কল্পনা স্বাধীন এটাই বাঁচোয়া…

– মেঘা

২৩শে জুলাই, ২০০৯

[ কোনও অজ্ঞাত কারণে দেখছি ব্লগে পোস্ট করার পর তারিখটি এক মাস আগের দেখাচ্ছে।

ওয়ার্ডপ্রেসের এ আজব টাইম মেশিন! ]